তাওয়াফ ও সাঈ এর জন্যে কি পবিত্রতা শর্ত?

প্রশ্ন উমরার তাওয়াফকালে আমার ওযু ছুটে গেছে। আমি কি করব তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে ওযু করে এসে পুনরায় তাওয়াফ শুরু করলাম। এরপর সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ (প্রদক্ষিণ) আদায় করলাম। আমি যা করেছি সেটা কি সহিহ? আমার কি করা উচিত ছিল? উমরার তাওয়াফকালে আমার ওযু ছুটে গেছে। আমি কি করব তা বুঝতে…

প্রশ্ন

উমরার তাওয়াফকালে আমার ওযু ছুটে গেছে। আমি কি করব তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে ওযু করে এসে পুনরায় তাওয়াফ শুরু করলাম। এরপর সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ (প্রদক্ষিণ) আদায় করলাম। আমি যা করেছি সেটা কি সহিহ? আমার কি করা উচিত ছিল?

উমরার তাওয়াফকালে আমার ওযু ছুটে গেছে। আমি কি করব তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে ওযু করে এসে পুনরায় তাওয়াফ শুরু করলাম। এরপর সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ (প্রদক্ষিণ) আদায় করলাম। আমি যা করেছি সেটা কি সহিহ? আমার কি করা উচিত ছিল?

আলহামদু লিল্লাহ।.

আপনি নতুনভাবে ওযু করে নতুনভাবে তাওয়াফ শুরু করে সঠিক কাজটি করেছেন। আপনি অধিক ভাল ও অধিক সতর্কতাপূর্ণ অভিমতের উপর আমল করেছেন। কেননা অধিকাংশ আলেমের মতানুযায়ী নামাযের ন্যায় তাওয়াফের শুদ্ধতার জন্য পবিত্রতা শর্ত। ওযু না করা পর্যন্ত অপবিত্র ব্যক্তির নামায যেমন শুদ্ধ হয় না তেমনি তাওয়াফও।

ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন:

“ইমাম আহমাদের মশহুর অভিমত হচ্ছে, অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন তাওয়াফের শুদ্ধতার জন্য শর্ত। এটি ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়িরও অভিমত।”[সমাপ্ত]

জমহুর আলেম এ অভিমতের পক্ষে নিম্নোক্ত দলিলগুলো পেশ করেন:

১। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “বায়তুল্লাহ্‌কে তাওয়াফ করা নামাযতুল্য; তবে তোমরা তাওয়াফের মধ্যে কথা বলতে পার।”[সুনানে তিরমিযি (৯৬০), আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

২। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াফ করতে চাইতেন তখন তিনি ওযু করে নিতেন।” আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম তো বলেছেন: “তোমরা আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ্জের কার্যাবলি শিখে নাও।”[সহিহ মুসলিম (১২৯৭)][ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (১৭/২১৩-২১৪)]

৩। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে সাব্যস্ত হয়েছে যে, আয়েশা (রাঃ) যখন হায়েযগ্রস্ত হন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বলেন: “একজন হাজী যা যা করে তুমিও তা তা কর; কিন্তু তুমি পবিত্র হওয়া অবধি তাওয়াফ করবে না।”

শাইখ বিন বায (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমার একজন নিকট আত্মীয়া রমযান মাসে উমরা আদায় করেছেন। তিনি যখন মসজিদে হারামে প্রবেশ করেছেন তখন তিনি লঘু অপবিত্র হয়েছেন। তার থেকে বায়ু বেরিয়েছে। কিন্তু, তিনি লজ্জা করে তার পরিবারকে বলেননি যে, ‘আমি ওযু করতে চাই’। এরপর তিনি তাওয়াফ করেছেন। তাওয়াফ শেষ করার পর তিনি একাকী গিয়ে ওযু করেছেন। এরপর সাঈ আদায় করেছেন। এমতাবস্থায়, তার উপর কী পশু জবাই (দম) করা কিংবা কাফ্‌ফারা দেয়া ওয়াজিব হবে?

জবাবে তিনি বলেন:

তার তাওয়াফ শুদ্ধ হয়নি। কেননা নামাযের মত তাওয়াফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য পবিত্রতা শর্ত। এখন তার কর্তব্য হচ্ছে, পুনরায় মক্কায় ফিরে গিয়ে তাওয়াফ আদায় করা। পুনরায় সাঈ আদায় করাও তার জন্যে মুস্তাহাব। কেননা অধিকাংশ আলেম তাওয়াফের আগে সাঈ আদায় করা জায়েয মনে করেন না। এরপর সমস্ত মাথার চুল ছোট করে হালাল হবে। আর এ নারী যদি সধবা হন এবং স্বামী তার সাথে সহবাস করে থাকেন তাহলে তার উপর পশু জবাই করে মক্কার দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া আবশ্যক হবে এবং প্রথম উমরা যে মীকাত থেকে আদায় করেছে সে মীকাত থেকে নতুন একটি উমরা করা আবশ্যক হবে। কেননা সহবাস করার কারণে প্রথম উমরা নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা যা উল্লেখ করেছি তার উপর সেটা অপরিহার্য হবে এবং প্রথম উমরা যে মীকাত থেকে আদায় করেছে সে মীকাত থেকে নতুন একটি উমরা আদায় করা আবশ্যক হবে। সে তাৎক্ষণিকভাবে আদায় করুক কিংবা পরবর্তীতে তার সুযোগ মত আদায় করুক। আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা।[সমাপ্ত][ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (১৭/২১৪-২১৫)]

তাঁকে আরও জিজাসা করা হয় যে: “এক ব্যক্তি তাওয়াফ শুরু করার পর তার বায়ু বেরিয়েছে; তার উপর তাওয়াফ কর্তন করা কী আবশ্যক; নাকি সে তাওয়াফ চালিয়ে যাবে?”

জবাবে তিনি বলেন: যদি কেউ তাওয়াফের মধ্যে বায়ু, পেশাব, বীর্য, লজ্জাস্থান স্পর্শ করা কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন কারণে অপবিত্র হয় তাহলে সে নামাযের ন্যায় তার তাওয়াফ স্থগিত করে পবিত্রতা অর্জন করতে যাবে; এরপর নতুনভাবে তাওয়াফ শুরু করবে। এটাই সঠিক অভিমত; যদিও এ মাসয়ালাতে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু, তাওয়াফ ও নামাযের ক্ষেত্রে এটাই সঠিক অভিমত। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি তোমাদের কেউ নামাযের মধ্যে নিঃশব্দে বায়ু ত্যাগ করে তাহলে সে যেন বেরিয়ে গিয়ে ওযু করে আসে এবং পুনরায় নামায আদায় করে।”[সুনানে আবু দাউদ, ইবনে খুযাইমা হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন। সামগ্রিক দৃষ্টিতে তাওয়াফ নামাযশ্রেণীয়][মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (১৭/২১৬-২১৭)]

কোন কোন আলেমের মতে, তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। এটি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর অভিমত। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এ অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন। তারা প্রথম অভিমতের দলিলগুলোর নিম্নোক্ত জবাব দেন:

যে হাদিসে বলা হয়েছে যে, “বায়তুল্লাহকে তাওয়াফ নামাযতুল্য” এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হিসেবে ‘সহিহ’ নয়; তবে এটি ইবনে আব্বাসের উক্তি। ইমাম নববী তার ‘আল-মাজমু’ কিতাবে বলেন: বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে- এটি ইবনে আব্বাসের উক্তি (মাওকুফ হাদিস)। বাইহাকী ও অন্যান্য হাফেযে-হাদিস মুহাদ্দিস এমনটি বলেছেন।[সমাপ্ত]

তারা আরও বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র অবস্থায় তাওয়াফ করা: এর দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না যে, পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা ওয়াজিব; বরং এর দ্বারা মুস্তাহাব সাব্যস্ত হয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এ আমল করেছেন। কিন্তু, সাহাবীদেরকে নির্দেশ দেননি।

আর আয়েশা (রাঃ) কে যে তিনি বলেছেন, “একজন হাজী যা যা করে তুমিও তা তা কর; কিন্তু তুমি পবিত্র হওয়া অবধি তাওয়াফ করবে না” : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রাঃ) তাওয়াফ করতে বাধা দেয়ার কারণ হল, আয়েশা (রাঃ) হায়েযগ্রস্ত থাকা। কেননা হায়েযগ্রস্ত নারী মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:

যারা তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা শর্ত বলেন: মূলতঃ দলিল তাদের পক্ষে নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাওয়াফের জন্য ওযু করার নির্দেশ বর্ণিত হয়নি; না সহিহ সনদে; আর না যয়ীফ (দুর্বল) সনদে। অথচ তাঁর সাথে বিশাল সংখ্যক মানুষ হজ্জ আদায় করেছেন। এবং তিনি কয়েকটি উমরাও করেছেন। তার সাথে অনেক মানুষ উমরা করেছে। তাই তাওয়াফের জন্য ওযু থাকা যদি ফরয হত তাহলে তিনি সাধারণভাবে সেটা বর্ণনা করতেন। আর তিনি যদি বর্ণনা করতেন তাহলে মুসলমানেরা তার থেকে সেটা বর্ণনা করতেন; অবহেলা করতেন না। কিন্তু, সহিহ হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি যখন তাওয়াফ করেছেন তখন তিনি ওযু করেছেন। শুধু এ দলিল ওয়াজিব হওয়ার নির্দেশনা দেয় না। কারণ তিনি প্রত্যেক নামাযের জন্য তাওয়াফ করতেন। তিনি আরও বলেছেন: “আমি পবিত্র না হয়ে আল্লাহ্‌র যিকির করা অপছন্দ করেছি…”[মাজমুউল ফাতাওয়া (২১/২৭৩)]

এই অভিমতটি অর্থাৎ ‘তাওয়াফের জন্য পবিত্রতার শর্ত না করা’ মজবুত হওয়া সত্ত্বেও এবং দলিল-প্রমাণে সে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কোন মানুষের পবিত্রতা ছাড়া তাওয়াফ করা উচিত নয়। কেননা পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা উত্তম, অধিক সতর্কতাপূর্ণ ও দায়মুক্তির অধিক উপযুক্ত – এতে কোন সন্দেহ নেই। এর উপর আমল করার মাধ্যমে ব্যক্তি জমহুর আলেমের অভিমতের বিপরীত আমল করা থেকে নিরাপদে থাকবে।

তবে, ওযু রক্ষা করতে গিয়ে তীব্র কষ্ট-ক্লেশের মুখোমুখি হলে মানুষ এ অভিমতের উপর আমল করতে পারে; যে পরিস্থিতি মওসুমগুলোতে তৈরী হয়ে থাকে। কিংবা ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয় নতুবা বয়োবৃদ্ধ হয় যাতে করে প্রচণ্ড ভীড়, তীব্র ঢেলাঠেলি ইত্যাদি কারণে ওযু রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।

শাইখ বিন উছাইমীন (রহঃ) জমহুর আলেমের দলিলগুলোর জবাব দেয়ার পর বলেন:

পূর্ব আলোচনার ভিত্তিতে বলতে পারি, যে অভিমতের প্রতি হৃদয় প্রশান্ত হচ্ছে সে অভিমতটি হচ্ছে: তাওয়াফের জন্য লঘু অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত নয়। তবে, কোন সন্দেহ নাই যে, পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা উত্তম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের দিক থেকে অধিক পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে জমহুর আলেমের বিরুদ্ধে গিয়ে এটি লঙ্ঘন করা উচিত নয়। কিন্তু, কখনও কখনও ব্যক্তি শাইখুল ইসলামের মনোনীত অভিমতটি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। যেমন- তীব্র ভীড়ের মধ্যে কেউ যদি অপবিত্র হয়, সেক্ষেত্রে যদি বলা হয় যে, বের হয়ে ওযু করে আসা তার উপর আবশ্যক এবং বিশেষতঃ তার যদি কয়েকটি চক্কর বাকী থাকে- এতে তীব্র কষ্ট রয়েছে। আর যাতে তীব্র কষ্ট রয়েছে এবং দলিল যদি সুস্পষ্ট না হয় সেক্ষেত্রে মানুষকে এমন অভিমতের উপর আমলে বাধ্য করা উচিত নয়। বরং আমরা সহজটির উপর আমল করব। কেননা দলিল ছাড়া কষ্টকর অভিমতের উপর মানুষকে আমল করতে বাধ্য করা আল্লাহ্‌র বাণী “আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; কঠিন করতে চান না” এর খিলাফ।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫; আল-শারহুল মুমতি (৭/৩০০)]

পক্ষান্তরে, সাঈ এর জন্য ওযু শর্ত নয়। এটি চার মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ি ও আহমাদের অভিমত। বরং হায়েযগ্রস্ত নারীর জন্যেও সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করা জায়েয। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম হায়েযগ্রস্ত নারীকে তাওয়াফ ছাড়া অন্য কিছু হতে বাধা দেননি। আয়েশা (রাঃ) হায়েযগ্রস্ত হলে তিনি তাকে বলেছেন: “একজন হাজী যা যা করে তুমিও তা তা কর; কিন্তু তুমি পবিত্র হওয়া অবধি তাওয়াফ করবে না।”[আল-মুগনী (৫/২৪৬)]

শাইখ ইবনে উছাইমীন বলেন:

সুতরাং কেউ যদি লঘু পবিত্রতা নিয়ে সাঈ করে, কিংবা গুরু অপবিত্রতা নিয়ে সাঈ করে কিংবা ঋতুবতী নারী সাঈ করে তাহলে তা জায়েয হবে। কিন্তু, উত্তম হচ্ছে পবিত্র অবস্থায় সাঈ করা।[আল-শারহুল মুমতি (৭/৩১০, ৩১১)]

আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.