শির্কের স্বরূপ ও এর প্রকারগুলো কি কি?

প্রশ্ন অনেক সময় আমি পড়ি: “এই কর্মটি বড় শির্ক, এটি ছোট শির্ক” । তাই এ দুটোর পার্থক্য কি একটু স্পষ্ট করবেন? অনেক সময় আমি পড়ি: “এই কর্মটি বড় শির্ক, এটি ছোট শির্ক” । তাই এ দুটোর পার্থক্য কি একটু স্পষ্ট করবেন? আলহামদু লিল্লাহ।. অতি আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বান্দা শির্কের অর্থ, এর ভয়াবহতা ও…

প্রশ্ন

অনেক সময় আমি পড়ি: “এই কর্মটি বড় শির্ক, এটি ছোট শির্ক” । তাই এ দুটোর পার্থক্য কি একটু স্পষ্ট করবেন?

অনেক সময় আমি পড়ি: “এই কর্মটি বড় শির্ক, এটি ছোট শির্ক” । তাই এ দুটোর পার্থক্য কি একটু স্পষ্ট করবেন?

আলহামদু লিল্লাহ।.

অতি আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বান্দা শির্কের অর্থ, এর ভয়াবহতা ও এর প্রকারগুলো অবগত হওয়া; যাতে করে তার তাওহীদ পরিপূর্ণতা লাভ করে, তার ইসলাম নিরাপদ থেকে এবং তার ঈমান আনা সহিহ হয়। আল্লাহ্‌র কাছে তাওফিক প্রার্থনা করে আমরা শুরু করছি:

জেনে রাখুন -আল্লাহ্‌ আপনাকে হেদায়েত লাভের তাওফিক দিন- শির্কের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: কোন অংশীদার গ্রহণ করা। অর্থাৎ একজনকে অপরজনের অংশীদার বানানো। যেমন দুইজনের মাঝে যৌথভাবে করা হলে বলা হয়: أشرك بينهما কিংবা যখন কোন একটি বিষয়ে দুইজনকে অংশীদার করা হয় তখন বলা হয়

أشرك في أمره غيره।

পক্ষান্তরে, শরয়ি পরিভাষায় শির্ক হল: আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন অংশীদার (شريك) বা সমকক্ষ (ند) নির্ধারণ করা; আল্লাহ্‌র রুবুবিয়্যতের ক্ষেত্রে কিংবা ইবাদতের ক্ষেত্রে কিংবা তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে।

ند হলো: সমকক্ষ ও সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে আল্লাহ্‌ তাআলা ند (সমকক্ষ) গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং যারা আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে তাঁর ند (সমকক্ষ) হিসেবে গ্রহণ করে কুরআনের অনেক আয়াতে তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَاداً وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ البقرة / 22

তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। অথচ তোমরা জান (আল্লাহ্‌ই স্রষ্টা, তিনিই রিজিকদাতা..)।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন:

وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَاداً لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِهِ قُلْ تَمَتَّعُوا فَإِنَّ مَصِيرَكُمْ إِلَى النَّارِ إبراهيم / 30

তারা আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য তাঁর বহু সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। আপনি বলুন, তোমরা উপভোগ করতে থাক। তোমাদের গন্তব্য হচ্ছে অগ্নি।)[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৩০]

হাদিসে এসেছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, সে আল্লাহ্‌র সাথে অপর কোন সমকক্ষকে ডাকে সে অগ্নিতে প্রবেশ করবে।”[সহিহ বুখারী (৪৪৯৭) ও সহিহ মুসলিম (৯২)]

শির্কের প্রকারভেদ:

কুরআন-সুন্নাহ্‌র দ্ব্যর্থহীন দলিলগুলো প্রমাণ করে যে, শির্ক কখনও কখনও ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। আবার কখনও কখনও ইসলাম থেকে খারিজ করে না। তাই আলেমগণ শির্ককে দুইভাগে ভাগ করার পরিভাষা গ্রহণ করেছেন: বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। এখন আমরা প্রতিটি প্রকারের পরিচয় তুলে ধরব।

এক: বড় শির্ক:

যেটি নিরেট আল্লাহ্‌র অধিকার এমন কোন অধিকার আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্যকে প্রদান করা; সেটা আল্লাহ্‌র রুবুবিয়্যত (প্রভুত্ব)-র ক্ষেত্রে হোক, কিংবা উলুহিয়্যত (উপাসত্ব)-এ হোক, কিংবা তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে হোক।

এ প্রকারের শির্ক কখনও প্রকাশ্য হতে পারে: যেমন- মূর্তি ও প্রতিমাপূজারীদের শির্ক কিংবা কবর, মৃতব্যক্তি ও অনুপস্থিত ব্যক্তি-পূজারীদের শির্ক।

আবার কখনও কখনও অপ্রকাশ্যও হতে পারে: আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য সব উপাস্যের উপরে যারা তাওয়াক্কুল করে, কিংবা মুনাফিকদের শির্ক ও কুফরের মত। কেননা মুনাফিকদের শির্ক যদিও বড় শির্ক, ইসলাম থেকে খারিজ কারী শির্ক, এই শির্ককারী স্থায়ী জাহান্নামী; কিন্তু এটি গোপন। যেহেতু তারা বাহ্যতঃ ইসলাম প্রকাশ করে এবং কুফর ও শির্ক গোপন রাখে। তাই তারা গোপনে মুশরিক; প্রকাশ্যে নয়।

এই শির্ক কখনও কখনও বিশ্বাসগত বিষয়গুলোতে হতে পারে: যেমন ঐ সব লোকদের বিশ্বাস যারা বিশ্বাস করে যে, এমন কিছু সত্তা রয়েছে যারা আল্লাহ্‌র সাথে সৃষ্টি করে, জীবন দেয়, মৃত্যু দেয়, মালিকানা লাভ করে এবং এ বিশ্ব পরিচালনা করে।

কিংবা এমন বিশ্বাস যারা করে যে, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা আল্লাহ্‌র মত নিঃশর্ত আনুগত্য প্রাপ্য। ফলে তারা সেসব ব্যক্তি যা হালাল করে ও যা হারাম করে সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করে; এমনকি সেগুলো যদি রাসূলদের শরিয়তের বিপরীত হয় তবুও।

কিংবা আল্লাহ্‌র ভালবাসা ও আল্লাহ্‌কে সম্মানপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে শির্ক: অর্থাৎ আল্লাহ্‌কে যেভাবে ভালোবাসে কোন মাখলুককে ঠিক সেইভাবে ভালোবাসা। এটি এমন শির্ক যা আল্লাহ্‌ ক্ষমা করবেন না। এই শির্ক সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য শরীকদেরকে আল্লাহ্‌র মত ভালোবাসে”।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৬৫]

কিংবা এমন বিশ্বাস যে, আল্লাহ্‌র সাথে আরও এমন কিছু মানুষ আছে যারা গায়েব জানে। কিছু কিছু পথভ্রষ্ট ফিরকার মধ্যে এ শির্কটি অধিক বিদ্যমান; যেমন- রাফেযিদের মধ্যে, চরমপন্থী সুফিদের মধ্যে, চরমপন্থী বাতেনীদের মধ্যে। যেহেতু রাফেযিরা তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানে। অনুরূপ বিশ্বাস বাতেনীরা ও সুফিরা তাদের আউলিয়াদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে।

কিংবা এমন বিশ্বাস করা যে, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা এমন অনুগ্রহ করেন; যে অনুগ্রহ কেবল আল্লাহ্‌ই করতে পারেন। অর্থাৎ তারাও আল্লাহ্‌র মত অনুগ্রহ করে— গুনাহ মাফ করার মাধ্যমে, বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে, তাদের গুনাহগুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে।

এই শির্ক কখনও কখনও বাচনিকও হতে পারে: যেমন যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার কাছে প্রার্থনা করল, অন্যসত্তার কাছে বিপদমুক্তির দোয়া করল, অন্যসত্তার কাছে সাহায্য চাইল, অন্যসত্তার কাছে আশ্রয় চাইল; যেগুলোর ক্ষমতা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারো নেই; এই অন্যসত্তা নবী হোক, ওলি হোক, ফেরেশতা হোক, জ্বিন হোক কিংবা অন্য কোন মাখলুক হোক। নিশ্চয় এটি বড় শির্ক ও ইসলাম থেকে খারিজকারী।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামকে নিয়ে ঠাট্টা করল কিংবা আল্লাহ্‌কে তার সৃষ্টির সাথে তুলনা দিল কিংবা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন স্রষ্টা, জীবিকাদাতা বা পরিচালনাকারী সাব্যস্ত করল—

এ সবগুলো বড় শির্ক ও জঘন্য গুনাহ; যা ক্ষমা করা হবে না।

আবার এ শির্ক কখনও কখনও কর্মে হয়ে থাকে: যেমন যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার জন্য জবাই করে, নামায পড়ে কিংবা সেজদা দেয়, কিংবা আল্লাহ্‌র বিধানের বিপরীত বিধান দেয় এবং মানুষের জন্য সেগুলোকে আইন হিসেবে জারী করে, সে সব আইনের কাছে বিচার চাওয়ার জন্য মানুষকে বাধ্য করে। অনুরূপভাবে যারা মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে ও তাদের মিত্রদেরকে সহযোগিতা করে। অনুরূপ আরও যে সব কর্ম মূল ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সে সব কর্মে লিপ্ত হওয়া ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।

দুই: ছোট শির্ক:

প্রত্যেক এমন সব বিষয় যা বড় শির্কের মাধ্যম কিংবা শরিয়তের দলিলে যে বিষয়গুলোকে শির্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সেগুলো বড় শির্কের গণ্ডিভুক্ত নয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শির্ক দুই দিক থেকে সংঘটিত হয়ে থাকে:

১। এমন কিছু উপায়-উপকরণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দিক থেকে আল্লাহ্‌ তাআলা যে সব উপায়-উপকরণের অনুমতি দেননি। যেমন- হাতের কব্জি, পুতি বা এ ধরণের কিছু এ বিশ্বাস নিয়ে লটকানো যে, এগুলো সুরক্ষার উপকরণ কিংবা এগুলো বদনজরকে প্রতিহত করে। অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা এগুলোকে এসবের উপকরণ বানাননি; না শরিয়তের বিধান হিসেবে; আর না তাকদীরের নিয়ম হিসেবে।

২। কিছু কিছু জিনিসকে এমন সম্মান প্রদর্শন করার দিক থেকে; তবে এমন সম্মান যেটা ঐ জিনিসকে রুবুবিয়্যতের পর্যায়ে পৌঁছায় না। যেমন- আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার নামে কসম করা কিংবা ‘যদি আল্লাহ্‌ ও অমুক না হত’ এভাবে বলা এবং এ ধরণের অন্যান্য কথা।

আলেমগণ শরিয়তের দলিল-প্রমাণে উদ্ধৃত বড় শির্ক থেকে ছোট শির্ককে আলাদা করার জন্য কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন। এই নীতিমালার মধ্যে রয়েছে:

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা যে, এই কর্মটি ছোট শির্ক। যেমন মুসনাদে আহমাদে (২৭৭৪২) এসেছে: মাহমুদ বিন লাবিদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয় করি ছোট শির্কের। সাহাবায়ে কেরাম বললেন: ছোট শির্ক কি? তিনি বললেন: রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা)। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাআলা যে দিন তার বান্দাদেরকে তাদের আমলের প্রতিদান দিবেন সেই দিন বলবেন: তোমরা দুনিয়াতে যাদেরকে প্রদর্শন করার জন্য আমল করতে তাদের কাছে যাও। গিয়ে দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কিনা?”[আলবানী আস-সিলসিলাতুস সাহিহা গ্রন্থে (৯৫১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

২. কুরআন-হাদিসে شرك (শির্ক) শব্দটি أل বিহীন نكرة হিসেবে উদ্ধৃত হওয়া। এ ধরণের প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট শির্ক উদ্দেশ্য করা হয়। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: إن الرقى والتمائم والتِّوَلَة شرك “নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তামীমা (তাবিজ-কবচ-মাদুলি), তিওয়ালা (বশীকরণ ও বিদ্বেষন মন্ত্র) শির্ক”।[সুনানে আবু দাউদ (৩৮৮৩), আলবানী সিলসিলাতু সাহিহা গ্রন্থে (৩৩১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] এ হাদিসে শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- ছোট শির্ক; বড় শির্ক নয়।

তামীমা (তাবিজ-কবচ-মাদুলি): এমন কিছু যা বাচ্চাদের গায়ে ঝুলানো হয়; যেমন- পুতি বা এ জাতীয় অন্য কিছু। তারা ধারণা করে যে, এটি বাচ্চাকে বদনজর থেকে রক্ষা করবে।

তিওয়ালা: এমন কিছু যা তৈরী করা হয় এ ধারণা থেকে যে, এটি স্বামীর কাছে স্ত্রীকে ও স্ত্রীর কাছে স্বামীকে প্রিয়ভাজন করবে।

৩. সাহাবায়ে কেরাম শরিয়তের দলিলগুলো এই বুঝ বুঝা যে, এখানে শির্ক দ্বারা ছোট শির্ক উদ্দেশ্য; বড় শির্ক নয়। নিঃসন্দেহে সাহাবায়ে কেরামের বোধ ধর্তব্য। কারণ তারা আল্লাহ্‌র দ্বীন সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং শরিয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিক অবহিত। এর উদাহরণ হচ্ছে যা আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন (হাদিস নং ৩৯১০) ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে; “তিনি বলেন: কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শির্ক। কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শির্ক। তিনবার বলেছেন। আমাদের মধ্যে যে কেউই এতে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ এটাকে দূর করে দেন।” এই হাদিসে: “আমাদের মধ্যে যে কেউই এতে লিপ্ত হয়…” এটি ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর কথা; যেমনটি উল্লেখ করেছেন বড় বড় মুহাদ্দিসগণ। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাসউদ (রাঃ) বুঝেছেন যে, এটি ছোট শির্ক। কেননা “আমাদের মধ্যে যে কেউই বড় শির্কে লিপ্ত হয়” তিনি এমনটি উদ্দেশ্য করতে পারেন না। তাছাড়া বড় শির্ক আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল দ্বারা দূরীভুত হয় না; বরং তাওবা দ্বারা দূরীভুত হয়।

৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শির্ক বা কুফর শব্দকে এমন কিছু দিয়ে তাফসির করা যার থেকে প্রমাণিত হয় যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- ছোট শির্ক; বড় শির্ক নয়। যেমনটি যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে বৃষ্টিপাতের পর হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেন: তোমরা কি জানো, তোমাদের প্রভু কী বলেছেন? তাঁরা বললেন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি বলেছেন: আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার প্রতি মু’মিন হয়ে ভোরে উপনীত হয়েছে। আর কেউ কেউ কাফের হয়ে ভোরে উপনীত হয়েছে। যে বলেছে: مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ (আমরা আল্লাহর করুণা ও রহমতে বৃষ্টি লাভ করেছি) সে আমার প্রতি মু’মিন (বিশ্বাসী) ও নক্ষত্রের প্রতি কাফের (অবিশ্বাসী)। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি কাফের (অবিশ্বাসী) ও নক্ষত্রের প্রতি মু’মিন (বিশ্বাসী)।”[সহিহ বুখারী (১০৩৮) ও সহিহ মুসলিম (৭১)]

এই হাদিসে কুফরের তাফসির কী সেটা অন্য একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা কি জানো না তোমাদের রব কি বলেছেন? তিনি বলেছেন: আমি যখনই আমার বান্দাদের উপর কোন নেয়ামত নাযিল করি, তখনই তাদের একদল এই নেয়ামতকে কুফুরী (অস্বীকৃতি) করে এবং বলে যে, নক্ষত্র ও নক্ষত্রের প্রভাবে আমরা নেয়ামত পেয়েছি।” এখানে স্পষ্ট করে দেয়া হল যে ব্যক্তি বৃষ্টিপাতকে নক্ষত্রের দিকে এই দিক থেকে সম্পৃক্ত করে যে, নক্ষত্রগুলো বৃষ্টিপাতের কারণ অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌ তাআলা নক্ষত্রগুলোকে এর কারণ বানাননি সেক্ষেত্রে এই ব্যক্তির এ কুফুরীটি হচ্ছে আল্লাহ্‌র নেয়ামতের কুফুরী (অস্বীকৃতি)। আর এটি সুবিদিত যে, কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করাটা ছোট শির্ক। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, নক্ষত্রগুলোই বিশ্বজাহান নিয়ন্ত্রণ করে, এগুলোই বৃষ্টিপাত করে তাহলে সেটা বড় শির্ক।

ছোট শির্ক কখনও কখনও প্রকাশ্য হতে পারে; যেমন- চুড়ি, সুতা, তাবিজ-কবচ-মাদুলি ইত্যাদি পরা।

আবার অপ্রকাশ্যও হতে পারে; যেমন- সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা)।

তেমনিভাবে ছোট শির্ক বিশ্বাসশ্রেণীয় বিষয়ে হতে পারে:

যেমন কেউ কোন কিছু ব্যাপারে এই বিশ্বাস করল যে, এটি কল্যাণ আনয়ন করে ও অকল্যাণ দূর করে; অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা এর মধ্যে এমন কোন উপকরণ রাখেননি। কিংবা কোন কিছুতে বরকত আছে বলে বিশ্বাস করা; অথচ আল্লাহ্‌ তাতে বরকত রাখেননি।

ছোট শির্ক কখনও কখনও কথাবার্তায়ও হতে পারে:

যেমন যারা বলেছিল যে, আমরা অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি লাভ করেছি; তবে তারা এমন বিশ্বাস করেনি যে, নক্ষত্রগুলো নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বৃষ্টি নাযিল করে। কিংবা যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোন সত্তার নামে কসম করেছে; তবে সেই সত্তা আল্লাহ্‌র সম মর্যাদাবান এমন বিশ্বাস ব্যতিরেকে। কিংবা যে ব্যক্তি বলল: আল্লাহ্‌ যা চান এবং আপনি যা চান; ইত্যাদি।

ছোট শির্ক কখনও কখনও কর্মের মাধ্যমেও হতে পারে:

উদাহরণত যে ব্যক্তি কোন রোগমুক্তির জন্য কিংবা রোগ থেকে দূরে থাকার জন্য তাবিজ-কবচ লটকায় কিংবা চুড়ি পরে কিংবা সুতা পরে। কারণ প্রত্যেক যে ব্যক্তি কোন কিছুকে অন্য কিছু জিনিসের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করল; অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা সেটাকে ঐ জিনিসের কারণ বানাননি; না শরয়ি বিধান হিসেবে; আর না তাকদীরের নিয়ম হিসেবে— সেই শির্ক করল। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বরকত লাভের আশায় এমন কিছুকে স্পর্শ করল আল্লাহ্‌ যাতে বরকত রাখেননি; যেমন- মসজিদের দরজাগুলোকে চুম্বন করা, কিংবা মসজিদের চৌকাঠ স্পর্শ করা, কিংবা মসজিদের মাটিকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা, ইত্যাদি অন্যান্য কর্ম।

এটি শির্কের দুটো প্রকার ছোট শির্ক ও বড় শির্ক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এই সংক্ষিপ্ত জবাবে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভবপর নয়।

উপসংহার:

একজন মুসলিমের উপর কর্তব্য ছোট শির্ক বা বড় শির্ক সকল শির্কের ব্যাপারে সাবধান থাকা। কেননা শির্ক হচ্ছে- আল্লাহ্‌র সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা, তাঁর অধিকারে সীমালঙ্ঘন করা। আল্লাহ্‌র অধিকার হচ্ছে- নিরঙ্কুশভাবে তার ইবাদত করা।

আল্লাহ্‌ তাআলা মুশরিকদের জন্য স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকাকে আবশ্যক করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তাদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْماً عَظِيماً

النساء / 48

(নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর চেয়ে লঘু গুনাহ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে সে মহা পাপে লিপ্ত হয়।)[সূরা নিসা, আয়াত: ৪৮]

তিনি আরও বলেন:

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ المائدة / 72

(নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে আল্লাহ্‌ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। জাহান্নামই তার আবাসস্থল। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।)[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭২]

তাই প্রত্যেক আকলবান ও দ্বীনদার ব্যক্তির উপর আবশ্যক নিজের ব্যাপারে শির্কে লিপ্ত হওয়াকে ভয় করা এবং নিজের প্রভুর কাছে শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য দোয়া করা যেমনিভাবে ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করে বলেছেন:

وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الأَصْنَامَ إبراهيم / 35

আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচান)[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৩৫] এজন্য জনৈক সলফে সালেহীন বলতেন: “ইব্রাহিম আলাইহি সালামের পর আর কোন ব্যক্তি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে।” তাই একজন বিশ্বস্ত বান্দা শির্ককে ভয় করা ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং তার প্রভুর কাছে তার তীব্র আগ্রহ হবে তিনি যেন তাকে শির্ক থেকে মুক্ত রাখেন। বান্দা ঐ সুমহান দোয়াটি করতে থাকবে যে দোয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন: اللهم إني أعوذ بك أن أشرك بك وأنا أعلم، وأستغفرك لما لا أعلم‏ (হে আল্লাহ্‌! জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি এবং অজ্ঞাতসারে করে ফেললে ক্ষমা চাচ্ছি।)[আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (৩৭৩১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

পূর্বে যা আলোচিত হয়েছে সেটি বড় শির্ক ও ছোট শির্কের স্বরূপগত পার্থক্য, প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ। পক্ষান্তরে, এ দুটোর হুকুমগত পার্থক্য হচ্ছে:

বড় শির্ক ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির উপর ইসলাম ত্যাগ ও মুরতাদ হয়ে যাওয়ার হুকুম দেয়া হয় এবং সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায়।

পক্ষান্তরে, ছোট শির্ক ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। বরং কখনও কখনও কোন মুসলিম ছোট শির্কে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবুও সে ইসলামের উপরেই থাকবে। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি ভয়াবহ শংকার মধ্যে রয়েছে। কেননা ছোট শির্ক কবিরা গুনাহ। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন: “আমি আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করা আমার কাছে অন্য কোন সত্তার নামে সত্য শপথ করার চেয়ে অধিক প্রিয়।” তিনি অন্য কোন সত্তার নামে শপথ করাকে (যেটা হচ্ছে ছোট শির্ক) আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করার চেয়ে জঘন্য নির্ধারণ করেছেন। অথচ এটি সুবিদিত যে, আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করা কবিরা গুনাহ।

আমরা আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদের অন্তরগুলোকে তাঁর দ্বীনের উপর অবিচল রাখেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। আমরা মহান আল্লাহ্‌র ইজ্জতের ওসিলা দিয়ে তাঁর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি তিনি যেন, আমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করেন। নিশ্চয় তিনি চিরঞ্জীব; যিনি মৃত্যুবরণ করবেন না; জ্বিন ও ইনসান মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ ও সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান এবং তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *